Chokher Bali (চোখের বালি) Review

🔷🔷🔷 স্পয়লার আছে🔷🔷🔷
“চোখের বালি”, শ্রুতিমধুর নামের দিকেই আশার ঝোঁক ছিল, কিন্তু বিনোদিনীর পরামর্শে আদরের গালিটিই গ্রহণ করিল। -রবীন্দ্রনাথ
আচ্ছা, যদি মহেন্দ্র জননীর কথামতো বিনোদিনীকে বিয়ে করতো, তাহলে আশালতাকে হয়তো বিহারীরই বিয়ে করতে হতো অথবা হতো না, আশা হয়তো দৃশ্যপটের বাইরেই থেকে যেতো। তবে এমনটা হলে তো আর এতোটা ঝড় তোলা উপন্যাসের সৃষ্টিই হতো না।
আবার যদি বিহারী রাজলক্ষীর কথায় রাজী হয়ে বিনোদিনীকে বিবাহ করতে যেতো তাহলে হয়তো গল্পের মাল্টিপল এন্ডিং থাকতে পারতো, আবার হয়তো নাও থাকতে পারতো।যাই হোক এসব কিছুই হয়নি, তাই হয়েছে যা আসলেই হবার ছিলো, সেটাই হয়েছে!
চোখের বালি উপন্যাস পড়ার আগে অনেকের কাছেই শুনেছিলাম বিনোদিনী হচ্ছে খল চরিত্র, দুষ্টু নারী। আসলেই কি তাই?! বিনোদিনী কি ভিলেন? কেন? খুবই ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় উপন্যাস ও চলচ্চিত্র দেখার পর… সেসময় অল্পবয়সে বিধবা হওয়া, শিক্ষিত, সুন্দরী, কর্তব্যপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও বারবার জীবনের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়া, কলকাতায় এসে যে ঘরের বউ তার হওয়ার কথা ছিলো সেখানে আশার মতো সংসার সম্বন্ধে নিতান্ত আনাড়ি এবং অশিক্ষিত গোমূর্খ একটা মেয়েকে দেখে তার প্রতি হিংসা হওয়া এই ঘটনাগুলো কি একেবারেই স্বাভাবিক নয়?! বিনোদিনী কি একটু কনফিউসড ছিলো? আমার তো মনে হয়না! মহেন্দ্রর সাথে তার সম্পর্কের মধ্যে শুরু থেকেই একটা দূরত্ব সে ঠিকই বজায় রেখেছিলো। সে তার সীমানা জানতো, যেরূপে সে বিহারীর কাছে নিজেকে সমর্পন করেছিলো এবং বিহারীর প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলো, অন্তত ওই ঘটনায় তাকে তাই মনে হয়েছে। সে তার সীমানা অতিক্রম করতে পারতো না বলেই মহেন্দ্রর কাছে সে আত্নসমর্পন করতে পারেনি, পারেনি বিহারীর বিয়ের প্রস্তাবকে লুফে নিতে।
অপরদিকে, মহেন্দ্রকে কিছুটা কনফিউসড ঠেকেছে আমার কাছে। শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগীতায় সে কখনোই জয়ী হতে পারেনি।অতঃপর, সে আশাকে ভালোবেসেছে, সাথে বিনোদিনীকেও। কিন্তু বিনোদিনী অধরা রয়ে যাবার কারণেই হয়তো টানটা সে বিনোদিনীর জন্যই অনুভব করেছিলো বেশি। ছোট বাচ্চারা যেমন নিজের অসংখ্য খেলনা থাকা সত্ত্বেও যেটা না পায় সেটার জন্য জিদ করে, মহেন্দ্রর অবস্থাও হয়েছিলো তাই। বারবার বিনোদিনীর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার পরও সে বিনোদিনীর কাছে আত্নসমর্পন করেছে। এজন্য এখানে সে দূর্বল পুরুষ চরিত্র মাত্র।
সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি ব্যবহারের কথা শুনেছিলাম বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সের্গেই আইজেনস্টাইনের এক সাক্ষাৎকারে যেখানে তিনি বলেন একজন চিত্রপরিচালক সাহিত্য থেকে সকল উপাদান পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেন, আবার আংশিক নিতে পারেন এবং আরেকটি হলো পয়সার জন্য করে সময় বাড়িয়ে যাওয়া। তবে এর বাইরে গিয়ে আরো একটি পদ্ধতি এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে দেখা যায় সেটিকে বলবো বিনির্মাণ। অর্থাৎ, কাহিনীর ভাব সম্পূর্ণ গ্রহণ করার পাশাপাশি কাহিনীর বক্তব্যকে একাধারে ছাড়িয়ে যাওয়া। অনুরূপভাবে, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষ তার চোখের বালি চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে যেটি করেছেন বা করতে চেয়েছেন সেটিকেও আপাতদৃষ্টিতে আমি বির্নিমাণ বলবো। তবে সেই বিনির্মাণের যথার্থতা নিয়ে সাধারণ দর্শক হিসেবে আমার ভিতরে কিছু খটকা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি সংশয় তৈরি হয়েছে উপন্যাস আর চলচ্চিত্রে বিনোদিনীকে উপস্থাপনের ভিন্নতা দেখে। চোখের বালি দেখতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনীর মধ্যে যতটা ব্যক্তিত্বের ছাপ, ঋতুপর্ণের বিনোদিনীতে ততটাই যেনো যৌনতার ছাপ। যৌনাবেদনময়ীতার কাছে বিনোদিনীর ব্যক্তিত্ব যেন অনেকটা মলিন হয়ে গেছে। তাই এই লেখার দু’টি ভাগে আমি সেই খটকা এবং সংশয়গুলো উপন্যাসের একজন সাধারণ পাঠক এবং চলচ্চিত্রের একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে বলার চেষ্টা করেছি মাত্র।
রবীন্দ্রনাথের লেখা চোখের বালির শেষাংশ নিয়ে পাঠক, সমালোচক, এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথের নিজের মধ্যেই নাকি নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। আর পরিচালক ঋতুপর্ণের ভাষায় উপন্যাসের শেষটা নাকি অধিক হাস্যকর, “উপন্যাসের সমাপ্তিটা বেশ হাস্যকর। হঠাৎ করেই সবাই কেমন সুখী হয়ে যায়, পরিবারটাকে খুব ভাল মনে হতে থাকে এবং তারা দুজনেই বিনোদিনীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। দুই পুরুষ মহেন্দ্র ও বিহারী বলে, ‘বৌদি, আমাদের ক্ষমা করে দাও, ভুল হয়েছে।’ সেও তাদের ক্ষমা করে দেয়। এরপর সে বেনারসে গিয়ে তপস্বীর মত জীবনযাপন শুরু করে।”
আর সেজন্যই ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালি চলচ্চিত্রের শেষটা একটু অন্যরকম করতে চেয়েছেন এবং করেছেনও বটে। চোখের বালি সিনেমার শেষের দিকে আমরা দেখি বিহারী বিয়ে করার প্রস্তুতি নিয়ে বিনোদিনীর কাছে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখে বিনোদিনী ঘরে নেই, চলে গেছে। কোথায় গেছে, কার কাছে গেছে কিছুই জানা যায় না। বিনোদিনী কেবল আশাকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লিখে যায়!
এবার আসি আমার ভাবনায়। উপন্যাসে বিনোদিনী কাসীতে চলে যায় অন্নপূর্ণার সাথে। আর সিনেমার বিনোদিনী কোথায় যায় তা আমার কাছে একেবারেই স্পষ্ট নয়। আমার কাছে বিনোদিনীকে কিন্তু নিরুদ্দেশই মনে হয়েছে। ঋতুপর্ণ বলছিলেন যে, উপন্যাসের চোখের বালি থেকে সিনেমা চোখের বালির শেষটা একেবারেই ভিন্ন হবে। রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসে মহেন্দ্র-বিহারীকে বিনোদিনীর পায়ের কাছে এনে ক্ষমা চাইয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই সমাজ থেকে তাকে বের করতে পারেন নি। আর আমার কাছে মনে হয়েছে পারেননি ঋতুপর্ণ নিজেও। বিনোদিনীকে তিনি নিরুদ্দেশ করেছেন, নারী থেকে মানুষ করে তুলতে পারেননি। এর কারণ নিরুদ্দেশ আর তপস্বীর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। প্রথা মেনে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ হলো তপস্বী, অন্যদিকে সমাজ-সংসার, সময়ের কাছে হেরে অপ্রথাগতভাবে নিয়তির কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া হলো নিরুদ্দেশ। কাউকে কিছু না বলে বিনোদিনীর প্রস্থান জীবনযুদ্ধ থেকে এক ধরনের পলায়ন। আর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া মানে তো হার মেনে নেওয়া। তাই শেষ পর্যন্ত উপন্যাস ও সিনেমাতে বিনোদিনীর পরিণতি আমার কাছে একই মনে হয়েছে।
উপন্যাসে দেখা যায়, মহেন্দ্র এবং বিনোদিনীর মধ্যে প্রতিনিয়তই দেখা হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রথমে মানসিক এবং পরে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অথচ সিনেমাটি দেখলে বুঝতে পারবেন, ঋতুপর্ণের চোখের বালি’তে মানসিক সম্পর্কের আগেই তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে শারীরিক সম্পর্ক। সিনেমার ক্ষেত্রে সময়ের উপস্থাপন, সময়কে তুলে ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ঋতুপর্ণ সেটা না করে, কেন জানি একেবারে অন্য পথে হেঁটেছেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্ব যেখানে, সেই মানসিক দ্বন্দ্ব, হৃদয়ের টানাপোড়েন পরাজিত হয়েছে ঋতুপর্ণের কাছে প্রাধান্য পাওয়া শারীরিক সম্পর্ককের আধিক্যের কাছে!
হ্যা পরকীয়া এবং মহেন্দ্র-বিনোদিনীর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি উপন্যাসেও ঢালাওভাবে ছিলো। কিন্তু ঋতুপর্ণের চোখের বালিতে আমার কাছে মনে হয়েছে, বিনোদিনীর সেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, বিচক্ষণতা ও ব্যক্তিত্ববোধের চেয়ে মহেন্দ্রকে বেশি আকৃষ্ট করেছে তার রূপ এবং যৌবন মানপ শারিরীক আকর্ষণ। আবার উপন্যাসের অসম্ভব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানসিক সৌন্দর্যের অধিকারিণী বিনোদিনীকে চলচ্চিত্রে মনে হয়েছে শুধুমাত্র একজন কামুক নারী। ফলে বিনোদিনীর প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবটাও থেকেছে অনেকটা উপেক্ষিত যেটা গল্পের মূল ভিত্তি।
এর বাইরে বিনোদিনীর আরো কিছু বিক্ষিপ্ত উপস্থাপনার কথা না বললেই নয়। ব্লাউজ পরা শেখানোর সময় বিনোদিনীর শারীরিক উপস্থাপনা পুরো সিনেমাতে তার ব্যক্তিত্বের ছাপকে ম্লান করে দেয়। এই দৃশ্যে বিনোদিনীকে প্রায় অর্ধ-নগ্ন করে উপস্থাপন করেন ঋতুপর্ণ। কাহিনীর প্রয়োজনে বিনোদিনীর ধবধবে পিঠ প্রদর্শন ঋতুপর্ণের কাছে প্রয়োজনীয় হলেও দর্শক হিসেবে আমার কাছে ছিলোনা একেবারেই। সেমিওলজিক্যালি একটু বিশ্লেষণ করে দিই ব্যাপারটা-
📌প্রথম শটে বিনোদিনীর উন্মুক্ত ধবধবে পিঠ দেখে দর্শক বুঝবে তার বুকও উন্মুক্ত।
📌 দ্বিতীয় শটে উন্মুক্ত পিঠের আংশিক দখল করে নেয় টকটকে লাল ব্লাউজ।
📌আর শেষ শটে ব্লাউজ পরা অবস্থায় সামনে থেকে দেখা যায় বিনোদিনীরূপী ঐশ্বরিয়াকে!
এহেন শটগুলো দেখে আমার যশোধরা রায়চৌধুরীর কিছু কথা মনে পড়লো তাই খুঁজে সেটা তুলে ধরলাম,” পর্নোগ্রাফির মেয়েরা নামক একটি প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ নগ্নতা পর্নোগ্রাফিতে অসম্ভব, কারণ তা পর্নোগ্রাফির মূল উদ্দেশ্যকে বানচাল করে দেয়। অর্ধ-আলোক, ছায়াময়তা এবং আধা-দেখা-যাওয়া নগ্নতাই পর্নোগ্রাফির মূল উপজীব্য, কারণ সম্পূর্ণ নগ্নতায় যে অন্যমনস্কতা ও সারল্য আছে তা দর্শককে সুড়সুড়ি দেয় না।”😶
চলচ্চিত্রের একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে অভিজ্ঞতা থাকলেও সমালোচক হিসেবে আমার আসলে তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তাও আবার রবীন্দ্রনাথ, ঋতুপর্ণ বলে কথা। তবুও উপন্যাস ও চলচ্চিত্র দুটির মধ্যে খটকা থেকে আমি যেটা বুঝেছি সেভাবে বলার চেষ্টা করেছি মাত্র। ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করছি কারণ এটা সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত মতামত।
হ্যাপি ওয়াচিং! 🍿🍿
Read More